শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো। Burdwan University (পূর্ণমান-10)
উত্তর : সাহিত্য ভাষা শিল্প। প্রত্যেক শিল্পী তাঁর শিল্পের একটা নাম দেন বা অভিধায় চিহ্নিত করেন তাঁকে নামকরণ বলে। নামকরণ সাধারণত তিন প্রকার • চরিত্রকেন্দ্রিক, ঘটনাধর্মী ও ব্যঞ্জনাধর্মী। এখন আমরা আলোচনা করে দেখার চেষ্টা করবো ‘মহেশ' গল্প কোন ধরণের নামকরণ তা সার্থক কিনা । অন্যান্য সাহিত্য রচনার মতো ছোটোগল্পেও নামকরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ শিরোনামের মধ্য দিয়েই সংশ্লিষ্ট ছোটোগল্পের চরিত্র-চিত্রণ অথবা কাহিনি বা লেখকের প্রাসঙ্গিক কোনো ভাবনার আভাস পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায় মহেশ ছিল দরিদ্র মুসলমান ভাগচাষি গফুরের পোষা এক বৃদ্ধ ষাঁড়।
মহেশকে গফুর এতই ভালোবাসে যে, সে ঘরের জীর্ণ চাল থেকে খড় টেনে মহেশকে খেতে দেয় এবং তারপর মেয়ে আমিনার কাছে জ্বরের ভান করে নিজের ভাতটুকু মহেশকে দিতে বলে। মানিক ঘোষ তাঁর বাগান নষ্ট করার অপরাধে মহেশকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে দিলে তাকে ছাড়াতে গফুর তার সম্বল পিতলের থালাটি বন্ধক দিতেও দ্বিধা করে না। একসময় মহেশকে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করার ক্ষণস্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গফুর অনুতপ্ত হয় এবং তাই সে জমিদারের কাছে নিজের কান নিজে মলে ওনাকখত দিয়ে অব্যাহতি ও শান্তি পায়। একদিকে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে খিদে-তেষ্টায় কাতর গফুর বাড়ি ফিরে তেষ্টা মেটাবার জল পর্যন্ত না পেয়ে অকারণেই আমিনাকে চড় মারে এবং অনুতপ্ত হয়।
ঠিক সেই সময়ে জমিদারের পেয়াদা মহেশের দুষ্কর্মের জন্য গফুরকে ডাকতে এলে পেয়াদার রূঢ় কথার জবাবে গফুরও কড়া কথা শুনিয়ে দেয় মহেশের দুষ্কর্ম এবং পেয়াদাকে কড়া জবাব দেওয়ার কারণে গফুরকে অবশেষে জমিদারের কাছে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। এদিকে জল নিয়ে বাড়ি ফেরা আমিনাকে ফেলে দিয়ে কলসি ভেঙে তৃষ্ণার্ত মহেশ জল খেতে থাকে। আমিনার চিৎকারে বেরিয়ে আসে ঘরে ফেরা বিধ্বস্ত গফুর এবং নিজেকে সামলাতে না পেরে লাঙলের মাথা দিয়ে সে মহেশের মাথায় সজোরে আঘাত করে তাকে হত্যা করে। এই ঘটনার পরে গফুর রাতের অন্ধকারে মেয়ে আমিনার হাত ধরে ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
এইভাবে দেখা যায়, সমগ্র গল্পের প্রতিটি ঘটনার কেন্দ্রে থাকা অবলা জীব মহেশের প্রতি গফুরের মমতা যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি এর জন্য প্রধান মনুষ্য চরিত্র গফুরকে সহ্য করতে হয়েছে বহু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং নির্যাতন। এমনকি যে গফুর অনেক অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টেও চটকলে কাজ করতে যেতে রাজি হয়নি, সেই গফুরই মহেশের মৃত্যুর পর কোনো দ্বিধা না করে ভিটে-মাটি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে ফুলবেড়ের চটকলের উদ্দেশে এবং যাওয়ার মুহূর্তে মহেশের জন্যই গফুরের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদ। সুতরাং গল্পের চরিত্রকেন্দ্রিক নামকরণ ‘মহেশ’ সার্থক।